তাবিতার টিউশনিটা অবশ্য এখন পর্যন্ত ছেড়ে দেই নি, তবে খুব সম্ভবতঃ অতি শীঘ্রই ছেড়ে দিব, তাই আগে থেকেই এই প্রবন্ধটা কম্পোজ করে রাখছি। পাঠক আপনি যদি এই আর্টিক্যালটা পড়তে পারেন তবে ধরে নেবেন যে, আমার ‘ডিয়ার’ ছাত্রী তাবিতাকে আমি বিদায় জানিয়েছি, অথবা তাকে আমায় বিদায় জানাতে বাধ্য করেছি। এর পেছনের কারণগুলো নিম্নরূপঃ
(১) প্রথমতঃ বলে রাখি, টাকার প্রয়োজনে তাবিতাকে পড়াতে যাই নি। তখন অনেকটা বেকার ছিলাম, তাই ভাবলাম কিছু একটা করি। এ কারণে গিয়েছিলাম তাদের বাসায়। কিন্তু মেয়েটা খুবই বেয়াদব। আধাঘণ্টা পড়লেই তার চান্দি গরম হয়ে যায়। আমার সামনে কলা-রুটি এসব খায়, অথচ আমাকে নাশতা দেয় না। একটু টিস্যু পেপার চাইলে বলে, ‘বাসা থেকে নিয়ে আসতে পারেন না?’ এছাড়া, তাদের বাসার টয়লেট ব্যবহার করতে দেয় না। বাইরে নাকি আরেকটা টয়লেট আছে, সেটাও দেখিয়ে দেয় না; বলে, ‘লাইট নষ্ট’। অর্থাৎ তার ও তার মা’র আচরণে মনে হয়, আমি নিতান্ত অভাবের তাড়নায় সেখানে টিউশনি করতে গিয়েছি।
(২) দ্বিতীয়তঃ বেতন নিয়ে কিছুদিন আগেই ‘কাহিনী’ করেছে। টিউশনি ফিক্স হবার সময় তাবিতার মা আমাকে বলেছিল, ‘স্যার, এই দুই মাস একটু সমস্যা। তাই ‘এই পরিমাণ’ টাকা কম দিমু। এর পর থেইক্কা পুরাডাই দিমু’। সেই কথা তো রাখেই নাই, উল্টা আমাকে অসহায় ভেবে প্রতিশ্রুত অর্থের মাত্র ৬০% দিতে চেয়েছিল মাসিক বেতন হিসেবে। পরে আমি প্রেশার ক্রিয়েট করে সেটাকে অরিজিনাল অ্যামাউন্টের ৮০%-এ উঠিয়ে এনেছি। তাতেই ওদের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। অথচ কিছুদিন পরপরই শপিং লেগে আছে।
(৩) তৃতীয়তঃ ওরা মিথ্যেবাদী, যেটার বেশ কয়েকটি নমুনা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। তাবিতা দাবী করে, ওর পিতা (মোহন মেম্বার) কোনো দুই নম্বরী করেন না, তাই তারা অপেক্ষাকৃত গরীব। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওদের ওয়ার্ডের মধ্যে রিপন মোল্লার দোকানের সামনে যে জুয়ার আড্ডা বসে সেটার ‘উপরি’র ভাগ কি মোহন মেম্বার পান না? না পেলে দিনদুপুরে জুয়ার আড্ডা চলে কীভাবে?
মানলাম, মোহন মেম্বার ইউনিয়নের অন্য মেম্বারদের চেয়ে আলাদা, তাই বিগত ১৩-১৪ বছর ধরেই তিনি মেম্বার। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এতই যদি জনপ্রিয় হন তিনি, তাহলে (তাবিতার দেয়া তথ্য মোতাবেক) ভোটের আগে বিশেষ কৌশল কেন নিতে হয় তাদের? যতদূর জানতে পেরেছি, আমার ওয়ার্ডের আনোয়ার মেম্বার টাকা ঢেলে ভোট কিনেছিলেন। তাহলে মোহন মেম্বারও কি সেটাই করে আসছেন? নাকি অন্য কিছু?
(৪) চতুর্থতঃ মিঠু মোল্লার বাসায় টিউশনিতে পাঠিয়ে তাবিতার মা অনেক বড় একটি ভুল করেছে আমার সাথে, যে ভুলের মাশুল এখন তাদেরকে দিতে হবে। তাবিতার মা এবং আমার অদূর প্রতিবেশী কামাল ভাইয়ের সুপারিশে ঐ রাজনৈতিক ফ্যামিলিতে আমি যাই টিউশনি করাতে। কিন্তু তারা মাত্র ১৫ দিন আমার সার্ভিস নিয়ে আমাকে বিদায় জানিয়ে আমাকে ব্যাপক অপমান করেছে, আমার আত্মবিশ্বাসের হানি ঘটিয়েছে। মিঠু মোল্লা ও তার কন্যা মায়শার বক্তব্য হচ্ছে, আমি ফিজিক্স ভালো পারলেও ম্যাথ ভালো পারি না। আমাকে এভাবে অপমানের সুযোগ ওরা পেয়েছে মূলতঃ তাবিতার মা’র কারণে। তাই এজন্য তাকে ও তার কন্যা তাবিতাকে মাশুল দিতে হবে।
(৫) পঞ্চমতঃ আমি আমার মূল কাজ বা পেশায় আবার ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি, এই ইতর পরিবারকে দেয়ার মতো সময় আমার কাছে নেই। তাও দিতাম যদি ‘চিপা-চাপা’র টাইম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতো, যেমনঃ রাত নয়-সাড়ে নয়, অথবা একেবারে সকালে (৭টা)। কিন্তু সবগুলো সুইটেবল টাইম অন্য কোচিংগুলোতে দিয়ে আমার কাছে ‘প্রাইম’ টাইম চায়, যেমনঃ বিকেল বেলা। সেটা এখন আর কী করে দেই?!
(৬) ষষ্ঠতঃ কিছুদিন আগে ছোটখাট একটা বিষয় নিয়ে আমাকে তিরষ্কার করেছে তাবিতার মা। ১লা এপ্রিল তারিখে তিনি আমাকে ‘এপ্রিল ফুল’ বানিয়েছেন, তিরষ্কার করে। এর আগের দিন (পড়ার সময়) তাবিতার গলার স্বর ছিল অত্যন্ত নিচু, কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। বারবার বলা সত্ত্বেও সে গলার স্বর উঁচু করছিল না, তাই বিরক্ত হয়ে মোবাইল টিপাটিপি করছিলাম। এটা নিয়ে আবার তাবিতা তার মাকে বিচার দিয়েছে, ‘মা, স্যার পড়ানোর সময় মোবাইল টেপাটিপি করে।’
আমি তো শুধু ঝাড়ি খেলাম; কী কারণে মোবাইল টিপছিলাম, সেটা বলতে পারলাম না। বুঝলাম, ঐ টিউশনিতে আমার ফ্রিডম আরেক ডিগ্রী কমে গেল। সেটা তখন মেনে নিয়েছিলাম, কারণ ভেবেছিলাম ‘বেকার থাকার চেয়ে কিছু একটা করা ভালো’। কিন্তু এখনকার ব্যাপারটা আলাদা, এখন যে পরিস্থিতি তাতে আমি উক্ত অপমানের প্রতিশোধ নিতেই পারি।
(৭) সপ্তমতঃ সম্প্রতি তাবিতা পরোক্ষভাবে আমার আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়েছে। সে একটা কথা এমন কনফিডেন্সের সাথে বলে যে, সেটা আমি বিশ্বাস করে নিয়ে ধরা খাই। আসলে সে এখন পর্যন্ত শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা ভাষা শিখতে পারে নি, তাই ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় কীভাবে কথা বলতে হয় জানে না। যেমনঃ ‘সে খারাপ’ এটা সরাসরি না বলে ‘তাকে আমার কাছে খারাপ মনে হয়’ – এটা হলো ডিপ্ল্যোম্যটিক ল্যাঙ্গুয়েজের একটি উদাহরণ।
কিছু একটা বলার সময় ‘সম্ভবতঃ’, ‘আমার মনে হয়’ – এ ধরনের কিছু বলতে পারলে রিস্ক কমে এবং কনফিউশনের পরিমাণও হ্রাস পায়। ‘ইতর’ এলাকার অরিজিনাল বাসিন্দা হওয়ার কারণে তাবিতা এগুলো এখনো শিখতে পারে নি। আমি নিজে বহুকাল আগে থেকেই এ ধরনের ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় এক্সপার্ট (যখন আমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ি)। তবে নটর ডেমে পড়াকালীন সময়ে বাংলা ম্যাডাম মারলিন ক্লারা পিনেরো আমাদেরকে এ ধরনের ‘ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা’র গুরুত্ব চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেন।
তাবিতার কারণে আমার প্রায় দশ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই টাকাটা আমার পকেটে আসলে সিলিন্ডারসমেত চুলার জন্য আলাদা একটা রান্নাঘর বানাতে পারতাম আমার বাড়িতে, যাতে করে বিস্ফোরণ টাইপের দুর্ঘটনা থেকে আমার বউ-বাচ্চা রেহাই পায়। নতুবা, ঐ অর্থ দিয়ে মোটামুটি বাজেটের এবং আইপিএস ডিসপ্লে’র একটা ফোন কিনতে পারতাম। আমার কেন জানি মনে হলো, তাবিতাকে পড়াতে থাকলে আরো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে আমাকে।
(৮) অষ্টমতঃ কিছুদিন আগে তাবিতারা আমাকে টিউশনি থেকে বাদ দেয়ার একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছিল। আসলে মাস শেষ হয়েছে এমন একটা সময়ে আমি কনফিউজড ছিলাম তারা আর আমাকে চায় কিনা। না চাইলে তো শুধু শুধু সেখানে গিয়ে লাভ নেই, সেক্ষেত্রে দু’চারদিন পরেই হয়তো বলবে, ‘স্যার, আপনে আর আইসেন না। বিভিন্ন কোচিং করে ওর আর সময় হইতেছে না।’ আর তখন তাবিতাও বলেছিল, ‘স্যার, আমি আপনেরে ফোন দিমু নে।’ তাই আমি ধরে নিলাম, ফোন দিলে বুঝতে হবে আমাকে তাদের দরকার আছে। আর ফোন না দিলে ধরে নিতে হবে, আমি তাদের কাছে অপাংক্তেয়, সেক্ষেত্রে জোর করে তাদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে লাভ নেই, শুধু শুধু অপমানের শিকার হতে হবে।
যাই হোক, তাবিতা আমাকে ফোন দিতে ভুলে গেল, তাই আমিও ধরে নিলাম, আমার প্রয়োজন সেখানে ফুরিয়ে গেছে, ফলে আমি আর ‘রেসপন্ড ব্যাক’ করলাম না। অথচ তখন তাবিতার মা আমাকে ফোন করে মোটামুটি ঝাঁড়ি মেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, আপনে কি পড়াইবেন, নাকি পড়াইবেন না?’ আমি নতি স্বীকার করলাম, আফটার অল এর আগের দিনও ঢাকায় অবস্থান করায় টিউশনিটা মিস দিয়েছিলাম। পরে জানতে পারলাম যে, আমাকে বাদ দেয়া হবে ভেবে তারা বিকল্প টিচারের খোঁজও করেছিল তাবিতার কাজিন সাদি’র কাছে, সে নাকি যেকোনো সময় ঢাকা থেকে কোয়ালিফাইড টিচার এনে দিতে সক্ষম! তাই আমিও এখন দেখতে চাই, আমি চলে যাওয়ার পর কী ধরনের কোয়ালিফাইড টিচার তারা ম্যানেজ করে এবং সে কী রকম পড়ায়। খোঁজখবর তো অবশ্যই পাব দূর হতে।
সবশেষে বলে দিই, আমার চোখে কারা আসলে ‘কুমিল্লার ইতর’। তাহলে প্রস্তুত হন ‘বিগ শক’-এর জন্য। শুনতে আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক, এটা আমার নিজস্ব মতামত যে, কুমিল্লার উত্তর দিকের কয়েকটি থানাঃ দাউদকান্দি, হোমনা, মুরাদনগর, মেঘনা, তিতাস, চাঁদপুরের কেবল মতলব, সম্পূর্ণ নরসিংদী, সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর নারায়ণগঞ্জ জেলার অরিজিনাল অধিবাসীদের সবাই আসলে ‘ইতর’ বা অভদ্র। আমার অভিজ্ঞতা অনুসারে, এদের কথাবার্তার ‘ডাইস’ ভালো না, লোকজনের সাথে কারণে-অকারণে খারাপ ব্যবহার করে। তাবিতা ও তার ফ্যামিলিও এর মধ্যে পড়ে, কারণ তারা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অরিজিনাল বাসিন্দা।
তবে আচরণ খারাপ বলে অন্যান্য দিক থেকেও যে খারাপ তা কিন্তু নয়। যেমনঃ নরসিংদীর লোকজন খুবই শিক্ষানুরাগী ও মেধাবী, এছাড়া নরসিংদীর মেয়েদের মাঝে একটা অন্য ধরনের সৌন্দর্য আছে বলে আমি মনে করি। তারা বেশ রোমান্টিকও বটে। বি.বাড়িয়ার লোকজনের মস্তিষ্ক অত্যন্ত শার্প। কুমিল্লা ও চাঁদপুরের লোকজন কিছু কিছু দিক থেকে বেশ উদার, যেমনঃ কারো উপকার করার বেলায় খুঁজে দেখে না যে, লোকটির হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়, তাকে উপকার করা ঠিক হবে কি হবে না – এসব। আর নারায়ণগঞ্জের অরিজিনাল বাসিন্দাদের ব্যাপারে বলতে চাই, এরা বেশ সাহসী ও অ্যাগ্রেসিভ; আফটার অল, এরা ঈশা খাঁ এবং তাঁর সহযোগীদের বংশধর।